রাখাইনে গণকবর থেকে ১০ রোহিঙ্গার গলিত লাশ উদ্ধার।

রাখাইনে গণকবর থেকে ১০ রোহিঙ্গার গলিত লাশ উদ্ধার।


মিয়ানমারের রাচিডং ও মংডুর মধ্যবর্তী আন্ডাং এলাকায় একটি গণকবর থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানের ১০টি গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সরকারি লোকজন গণকবর খনন করে দেহাবশেষ বের করে। স্থানীয় রোহিঙ্গারা উদ্ধারকৃত লাশের পরিচয় শনাক্ত করেছেন।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন চলাকালীন সীমান্তরী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) আন্ডাংয়ের বিভিন্ন গ্রামের শত শত রোহিঙ্গা পুরুষকে আটক করে। গণহারে ধর্ষণ করে রোহিঙ্গা নারীদের। ওই মাসের ৩১ তারিখে আটক রোহিঙ্গাদের গুপ্তহত্যা করে লাশ গোপন করে বিজিপি। গর্তে লাশের পর লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়। সন্ধান পাওয়া গণকবরটি সেসব রোহিঙ্গার বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আশপাশের পাহাড়ে এ ধরনের আরো গণকবর থাকতে পারে।
উদ্ধার হওয়া দেহাবশেষগুলো হচ্ছেÑ স্থানীয় মোহাম্মদের পুত্র মৌলভী আব্দুল মালেক (৩৫), কামরুলের পুত্র আবুল হাশিম (৩০), আবুল কালামের পুত্র আব্দুল্লাহ (২১), নুর মোহাম্মদের পুত্র হাফিজুল্লাহ (২৮), আব্দুল শুক্কুরের পুত্র রশিদ (২০), মোহাম্মদের পুত্র আব্দুল মজিদ (৪৫), আমান উল্লাহর পুত্র বান্ডু (২৫), ইউছুফের পুত্র দিলু (৩০), আব্দুর রহমানের পুত্র বোতা মিয়া (৪৫) ও মোহাম্মদের পুত্র রফিকের (২৫)। 
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, হত্যার শিকার বেশির ভাগ রোহিঙ্গার বয়স ২০-৩৫-এর মধ্যে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা তরুণ ও যুবক তাদের টার্গেট করেই মূলত কিলিং অপারেশন চালিয়ে সরকারি বাহিনী। হত্যাকারীরা এর দায় রোহিঙ্গাদের ওপর চাপিয়ে মিথ্যাচারও করতে পারে। ইতঃপূর্বে দু’টি গণকবর থেকে উদ্ধারকৃত লাশকে প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়েছিল সেনা কর্তৃপ।
রোহিঙ্গারা বলছেন, ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী যে তাণ্ডব শুরু করে সে সময় শত শত রোহিঙ্গাকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তাদের লাশ গোপন করার জন্য গণকবর দিয়েছে। হেলিকপ্টারে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। আবার মংডুর ফকিরা বাজারে কিছু গলিত লাশ উদ্ধার করে সেসবের হত্যার দায় রোহিঙ্গাদের ওপর চাপিয়েছিল সৈন্যরা। হিন্দুদেরকে চাপ প্রয়োগ করে মিডিয়ার সামনে স্যা দিতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ থেকে ২৭ জন আরাকানি হিন্দুকে নিয়ে গিয়ে প্রলোভনের মাধ্যমে মিথ্যা বিবৃতি নেয়।
এ দিকে মিয়ানমারের সর্বাধিক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনবহুল গ্রাম বুচিডংয়ের মোস্তাফিজপাড়া, ছামিলাপাড়া ও কুয়াইচংপাড়া গ্রামের প্রায় ১৮ হাজার রোহিঙ্গা এপারে চলে আসার জন্য নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের ধনখালী এলাকায় জড়ো হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ভোররাতে ৫০ পরিবারের প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা সীমান্তের নাফ নদী পার হয়ে কুতুপালং এসে পৌঁছলে ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও তাদের খাদ্য ও মানবিক সেবা দিয়ে মধুরছড়া ক্যাম্পে স্থানান্তর করেছে। ওইসব রোহিঙ্গার দাবিÑ মিয়ানমার সরকার সেখানে একজন রোহিঙ্গাকেও থাকতে দেবে না।
গত মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় গেলে সেখানে বুচিডংয়ের মোস্তাফিজপাড়া, ছামিলাপাড়া ও কুয়াইচংপাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা জানান, বুচিডং ছামিলার দরিয়া পার হয়ে ২০০ মাইল পথ হেঁটে রাখাইন ধনখালী সীমান্তে জড়ো হতে তাদের মাসাধিককাল সময় লেগেছে। খাবারদাবার বলতে তাদের কিছুই নেই। রাখাইনের আশপাশের কিছু রোহিঙ্গা পরিবার তাদের খাবার দিলেও অনেকেই অনাহারে-অর্ধহারে রয়েছেন। 
মধুরছড়া ক্যাম্পে আসা বুচিডং মোস্তাফিজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাকিম আলীর ছেলে ছৈয়দ উল্লাহ (৪৫) জানান, তাদের গ্রামে কোনো দিন সেনা সদস্যরা যায়নি; কিন্তু ১ মাস আগে হঠাৎ করে সেনা ও উগ্রপন্থী রাখাইনরা গ্রামে ঢুকে তাদের বসতভিটা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে তারা সহায়সম্পদ ফেলে এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। 
তাদের দলের আরেক রোহিঙ্গা বুচিডং ছামিলাপাড়া গ্রামের হোছন আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আলী (৪৭) জানান, মোস্তাফিজপাড়া, ছামিলাপাড়া ও কুয়াইচংপাড়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের গ্রামের বাইরে যেতে দিচ্ছে না সেনারা। তারা মাঝে মধ্যে ফাঁকা গুলি করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে। কুয়াইচংপাড়া গ্রামের বিধবা মাহামুদা (৫০) জানান, সব কিছু ফেলে তিনি ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলে নিয়ে চলে এসেছেন। আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমারে কোনো রোহিঙ্গার স্থান হবে না। আজ হোক, কাল হোক রোহিঙ্গাদের এ দেশে চলে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর প্রোগ্রাম অফিসার সৈকত বিশ্বাস নতুন করে রোহিঙ্গা আসার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন ৫০-৬০ জন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকছেন। 
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মঙ্গলবার ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে ডাক্তার মোহাম্মদ জাফর আলম, ডাক্তার ফয়সাল, মাস্টার আরিফসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, ২৩ নভেম্বর সম্পাদিত ২ দেশের সমঝোতাস্মারকে রোহিঙ্গা উল্লেøখ করার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তাব দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা না বললেও বাঙালি শব্দটি বারবার উচ্চারণ করছিল। এ সময় উভয় পক্ষ সম্মত হয়, রোহিঙ্গা এবং বাঙালি শব্দটি উচ্চারণ না করে ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মানুষ’ এ রকম একটি ভাষা ব্যবহার করার জন্য উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু গত মঙ্গলবারের বৈঠকে মিয়ানমার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এতে প্রতীয়মান হয় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি স্রেফ একটি প্রতারণা। 
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলামের সাথে মিয়ানমারের ধনখালী এলাকায় ১৮ হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পার হয়ে অনুপ্রবেশ করছে। পরে তাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.