যদি হঠাৎ কমে যায় দেহের ওজন

যদি হঠাৎ কমে যায় দেহের ওজন


মানবদেহের ওজন দেশ, জাতি, স্ত্রী, পুরুষ, উচ্চতা ও বয়স ভেদে কমবেশি হয়ে থাকে। তবে এসবের তারতম্য অনুযায়ী মানবদেহের স্বাভাবিক ওজন আছে এবং জন্মের সময়ই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক শিশুর পূর্ণতা অনুযায়ী স্বাভাবিক ওজন দিয়ে থাকেন; যেটা ভবিষ্যতে পুষ্টি, বংশগত প্রভাব,
অসুখ-বিসুখ না হওয়া, মানসিক প্রশান্তি, পরিবেশ ইত্যাদির ফলে ওজন কমবেশি হয়ে থাকে। লিখেছেন ডা: মো: আকমান আলী
বর্তমানে পশ্চিমা খাদ্যের প্রভাবে ফাস্টফুডের প্রচলনে মানবদেহের ওজন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে পরবর্তীকালে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, মেদ বৃদ্ধি, হৃদরোগ ইত্যাদি হয়ে থাকে। 
তবে যেকোনো সময় হঠাৎ করে যদি কয়েক মাসের মধ্যে শরীরের ওজন কমে যায়, তবে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয় এবং এর কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি। অনেকে পথ্য নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যায়াম ও পরিশ্রম করে শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ করে যদি অল্প সময়ে বেশি ওজন কমে যায়, তখনই চিন্তার বিষয় এবং যতদ্রুত সম্ভব কারণ বের করে চিকিৎসার মাধ্যমে ওজন স্বাভাবিক রাখা যায়। 
ওজন কমার কারণ
শরীরের ওজন তখনই কমে, যখন শরীরের মাংস, পানি বা চর্বি কমে যায়। যদিও পথ্য নিয়ন্ত্রণ করে ওজন কমানো যায়, তবে এক বছরে যদি ৫ শতাংশ ওজন কমে যায়Ñ সেটা গুরুতর কোনো কারণ হতে পারে। সাধারণত মানুষের উচ্চতা যত সেন্টিমিটার, তা থেকে ১০০ বিয়োগ করলে যত হয়, তত কেজিই হচ্ছে স্বাভাবিক ওজন। যেমনÑ কারো উচ্চতা যদি ১৬০ সেন্টিমিটার হয়, তবে স্বাভাবিক ওজন হবে (১৬০-১০০) বা ৬০ কেজি। 
প্রধান কারণগুলো
খাবারের সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ক্যান্সার 
দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিস। 
অন্যান্য কারণÑ এইডস; হাইপারথাইরয়েডিজম; আর্থ্রাইটিস; যক্ষ্মা; কিডনিবৈকল্য; জি-ই-আর-ডি; ফুসফুসের সমস্যা। তা ছাড়া বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়া ড্রাগের অপব্যবহার, ল্যাক্সেটিভের অপব্যবহার, অপুষ্টি, পারকিনসন্স ডিজিজ ও অন্ত্রনালীর বাধাও হঠাৎ ওজন কমার কারণ হতে পারে। 
খাবারের সমস্যা
আমাদের এটা জানা উচিত, শরীরের ওজন নির্ভর করে খাবার গ্রহণের ওপর। আমরা যদি ইধষধহপবফ ফরবঃ গ্রহণ করি, তবে শরীরের ওজন ঠিক রাখা সম্ভব। তাই যখন পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করা বন্ধ করি তখন ওজন কমে যায়। এটা তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা খাদ্য সমস্যায় ভোগেন; যেমনÑ র) অহড়ৎবীরধ ঘবৎাড়ংধ রর) ইঁষরসরধ হবৎাড়ংধ. অহড়ৎবীরধ ঘবৎাড়ংধ হচ্ছে মানসিক সমস্যা, যখন ওই ব্যক্তির অত্যধিক ভয় থাকে ওজন বেড়ে যাওয়ার। ফলে খাদ্য গ্রহণ একদম কমিয়ে দেয় এবং শীর্ণকায় হয়ে যায়। অন্য দিকে ইঁষরসরধ হবৎাড়ংধ হচ্ছে যখন খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খায়; কিন্তু খাবার গ্রহণের পর বমি করে বা অত্যধিক ব্যায়াম করে যাতে ওজন বৃদ্ধি না পায়। এ দুই কারণেই হঠাৎ ওজন কমে। এর চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করা দরকার, নতুবা জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে; যেমনÑ খাবার গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়। বিশেষত ২০ বছর বয়সের মেয়েদের ক্ষেত্রে এ রকম হয়ে থাকে।
মানসিক সমস্যা
হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া মানসিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। যেমনÑ মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্ন থাকা। বর্তমান ব্যস্ততম পৃথিবীতে বিভিন্ন কারণ যেমনÑ (চাকরি বা ব্যবসা) কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন অবস্থার জন্য মানসিক চাপ হয়ে থাকে। এই চাপ থেকে বের হতে না পারলে তা দৈহিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। যেমনÑ হঠাৎ ওজন কমা, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া, মাথাঘোরা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্ন ছাড়াও কিছু কারণ; যেমনÑ ডিপ্রেশনে ওজন কমাতে পারে। ডিপ্রেশনে রোগী সব সময় বিষণœ ও উদ্বিগ্ন থাকেন, যার কারণ হচ্ছে কিছু মানসিক, পারিপার্শ্বিক বা জেনেটিক। এদের ক্ষুধা খুব কমে যায় এবং এরা হজমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। ফলে হঠাৎ ওজন কমে যায়। 
ক্যান্সার
ক্যান্সার জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ, যা হঠাৎ ওজন কমার অন্যতম একটা কারণ। যে ক্যান্সারই হোক, যেমন রক্তের ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াস, ফুসফুস, পাকস্থলী বা লিভার প্রতিটি ক্যান্সারেই হঠাৎ ওজন কমে যায় এবং দ্রুত এই লক্ষণ সাধারণত দেখা দেয়। কারণ হচ্ছে এসব অসুখে শরীরের পরিপাকক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। ফলে শরীরে বেশি বেশি ক্যালরি নষ্ট হয় এবং ওজন হ্রাস পায়। কিছু রোগী ক্যান্সার চিকিৎসার সময় হঠাৎ বেশি ওজন কমে যাওয়া উপলব্ধি করে। 
ধূমপান বিষপানের সমান। ধূমপান করলে শুধু ফুসফুসের ক্যান্সার নয়, বরং কিডনি, পাকস্থলী, মুখগহ্বর, অন্ত্রনালী ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারও হতে পারে। তাই ধূমপান ত্যাগ করা জরুরি। 
এ জন্য উপদেশ হচ্ছেÑ
ধূমপানের ইচ্ছা ত্যাগ করুন, ধূমপানের ইচ্ছা হলে অন্য কাজে মনোযোগ দিন।
ধূমপানের ইচ্ছা হলে ফলমূল খান, ভিটামিন ‘সি’ খান
ধূমপানের সমস্যাগুলো জানুন, চিহ্নিত করুন, বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ করুন।
মনকে সব সময় ইতিবাচক চিন্তার অনুসারী করুন।
নিজেকে অধূমপায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করুন।
কী করবেন 
অধিক আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন; যাতে অন্ত্রনালী ও পায়ুপথ ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারেন। তাই অধিক ফলমূল, লাল আটা ও চাল, শস্যদানা, কমলা ও টমেটো গ্রহণ করবেন। 
টাটকা শাকসবজি খানÑ সবুজ, হলুদ ও পাতাযুক্ত শাকসবজি (বাঁধাকপি, ফুলকপি) অন্ত্রনালী, পায়ুপথ, পাকস্থলী ও অন্যান্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। 
ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ আছে, এমন খাবার গ্রহণ করুনÑ ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার, যেমনÑ টাটকা ফল, সবুজ শাকসবজি, দুধজাতীয় খাদ্য ও কলিজা পায়ুপথ ও জরায়মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’সমৃদ্ধ খাবার; যেমনÑ আমলকী, আমড়া, পেয়ারা, কমলা, কাঁচা মরিচ, টমেটো ইত্যাদি খাবারও অন্ত্রনালী, পাকস্থলী, পায়ুপথ ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। 
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুনÑ এ জন্য নিয়মিত ব্যায়াম (হাঁটার অভ্যাস বেশ উপকারী) এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত খাদ্য পরিহার করুন। 
ক্যান্সারের সম্ভাব্য লক্ষণ
কোনো ক্ষত না শুকানোর প্রবণতা
পায়খানার অভ্যাসের পরিবর্তন বা মাঝে মধ্যে পাতলা অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ 
স্তনে কোনো দলা বা শক্ত চাকা হওয়া
পেটে অজীর্ণতা বা ঢোক গিলতে সমস্যা 
গলা বসে যাওয়া বা অবিরাম কাশি হওয়া
আঁচিল বা তিলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন। 
দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া
অনেকেরই ভুল খাবার খেয়ে বা ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণুঘটিত কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের কিছু ডায়রিয়া জীবাণুবিধ্বংসী ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও চার সপ্তাহের বেশি ডায়রিয়া চললে তাকে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া বলে। অন্যান্য কারণ যেমন আইবিএস, সিলিয়াক ডিজিজ, ইনফ্লামেটরি বাউয়েল ডিজিজ ইত্যাদি কারণেও হতে পারে। এর ফলে হঠাৎ শরীরের ওজন কমতে পারে। 
ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস হঠাৎ ওজন কমার অন্যতম কারণ হলেও এটি সাধারণত টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিস দেখা যায়। এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে যুবক, শিশু ও ৩০ বছরের কম বয়সীদের জন্য, যখন শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে শরীরে তৈরি গ্লুকোজ দেহের কোষে পৌঁছতে পারে না। গ্লুকোজ হচ্ছে প্রধান জিনিস, যা আমাদের শরীরে কাজ করার শক্তি দেয় এবং যখন কোষ গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারে না, তখন রক্তের ভেতর এই গ্লুকোজ বৃদ্ধি পেয়ে ডায়াবেটিস হয়। ফলে শরীর যথেষ্ট শক্তি (ক্যালরি) না পেয়ে হঠাৎ ওজন কমে যায়। 
হঠাৎ ওজন কমে যাওয়ার চিকিৎসা
যে কারণে হঠাৎ ওজন কমে যায়, সেসব কারণের চিকিৎসা করেই প্রকৃত চিকিৎসা করা সম্ভব। তাই আপনি যদি হঠাৎ ওজন হারান, তবে এ রোগের কারণ নির্ণয় করার জন্য প্রকৃত ডাক্তারের কাছে যেতে দেরি করবেন না। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত কারণ নির্ণয় করবেন এবং এর চিকিৎসা করবেন। মানসিক সমস্যার জন্য মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। 
তা ছাড়া ওজন কমার চিকিৎসায় আরো প্রয়োজন ব্যালান্সড পথ্য, নিয়মিত ও পরিমিত ব্যায়াম এবং অবশ্যই যথেষ্ট বিশ্রাম। আপনার চিকিৎসককে সব কিছু বলে ব্যবস্থা নেবেন। কেননা হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া মারাত্মক অসুখ-বিসুখের লক্ষণ, যা আগে নির্ণয় করলে এসব অসুখ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ভারসাম্যপূর্ণ পথ্য 
সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পথ্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সঠিক পথ্য পরিকল্পনা করা কঠিন। পথ্য তখনই ভারসাম্যপূর্ণ হবে, যখন খাবারে অনুপাতিক হারে শর্করা, আমিষ, ভিটামিন ও খনিজ বিদ্যমান থাকে এবং তা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি সরবরাহ করে। খাবারের ৫০ শতাংশ ক্যালরি জটিল শর্করা থেকে, ২০ শতাংশ আমিষ থেকে এবং ৩০ শতাংশ চর্বি থেকে এলে তা স্বাস্থ্যকর অনুপাত। 
কিছু টিপস
ভারসাম্যপূর্ণ পথ্যে প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার, ডালসহ চাল, আটা, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি। 
তেল, চর্বিযুক্ত খাবার ও চিনি কম গ্রহণ করা। কারণ এই খাবার স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং প্রকৃতপক্ষে এগুলো শরীরে ক্যালরি ও কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। 
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ পরিহার করুন। কেননা এটি বেশি গ্রহণকারীদের জন্য ক্ষতিকর। 
প্যাকেটজাত বা টিনজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। এসব খাবার ক্যালরি, চর্বি, চিনি, কৃত্রিম রাসায়নে সমৃদ্ধ থাকে। 
কোমলপানীয় ও মদজাত দ্রব্য পরিহার করুন।
প্রতিদিন যথেষ্ট পানি পান করুন। 
লেখক : চিফ মেডিক্যাল অফিসার, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.